Friday, July 17, 2015

যোগ্য বলেই লিটন দাস বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে খেলার সুযোগ পান


ঘটনা ১ঃ

১৯৭৪ সালে সোমারসেট কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের ভাইস চেয়ারম্যান লেন ক্রিড অ্যান্টিগা সফরে আসেন। লেন ছিলেন একজন ক্রিকেটের গ্রেট ফলোয়ার যিনি প্রায়ই নিজের একটি দল নিয়ে শীতের মৌসুমে সোমারসেট কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের জন্য নতুন প্রতিভা অন্বেষণের উদ্দেশ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপ রাষ্ট্র গুলো সফর করতেন। লেনের সফরকারী দল গুলো হতো মাল্টিন্যাশনাল। ভারতীয়, পাকিস্তানী এবং বিশ্ব ক্রিকেটের দুই থেকে তিনজন নামকরা খেলোয়াড়, যারা শীত মৌসুমে ফ্রি থাকতেন, তাদেরকে নিয়ে তৈরি করা দল নিয়ে তিনি ক্যারিবিয় দ্বীপ গুলো সফর করতেন।

সফরের আগে লেন, কলিন কাউদ্রির কাছ থেকে একটি ছেলের ব্যাপারে শুনে এসেছিলেন। কলিন, লেনকে বলেছিলেন যে গত বছরের (১৯৭৩ সাল) ট্যুরে তিনি খুব সম্ভাবনাময় একটি তরুন ব্যাটসম্যান দেখেছেন যার নাম ভিভ রিচার্ডস। লেন যেন তার দিকে একটু নজর রাখেন। সফরের শুরু থেকেই লেন ভিভের ব্যাপারে খুব প্রশংসা শুনছিলেন। অনেকের সাথেই কথা বলে তিনি জানতে পারলেন যে ঐ ব্যাটসম্যান কাউন্টি খেলার জন্য যোগ্য। কিন্তু শুধু মুখের কথাতেই তো লেন মেনে নিবেন না। স্বচক্ষে ঐ ছেলেটির ব্যাটিং না দেখে লেন কোন সিদ্ধান্তে আসবেন না।

লেনের সফরকারী দলের সাথে অ্যান্টিগার খেলা শুরু হলো। ভিভ মাত্র ৩২ রান করেই আউট হয়ে গেলেন। অ্যান্টিগার দর্শক খুব হতাশ কিন্তু লেন একটুও হতাশ হননি। তিনি সোমারসেটের প্রেসিডেন্টকে ভিভের ব্যাপারে সুপারিশ করলেন। কিন্তু সোমারসেটের প্রেসিডেন্ট কোন ভাবেই ভিভকে নিতে চাচ্ছিলেন না। কারন উনি ‘আনকোরা’ কোন খেলোয়াড়কে নিয়ে রিস্ক নিতে চান না। কিন্তু লেন নাছোর বান্দা এবং প্রেসিডেন্টকে বলে দিলেন যে যদি ভিভ কাউন্টিতে অসফল হয় তাহলে তিনি নিজের পকেট থেকে ক্ষতিপূরণ দিবেন। কারন লেনের মতে, তিনি এমন একজন প্রতিভার সন্ধান পেয়েছেন যে কিনা বিশ্ব ক্রিকেটের চিত্রটাই বদলে দিবে। ভিভ সমারসেটে আসলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়েও খেলা শুরু করলেন। বাকিটা শুধুই ইতিহাস।

ঘটনা ২ঃ

ইমারান খানের নিজের কিছু স্কাউট ছিলো। তারা প্রায়ই ইমরানকে বিভিন্ন ক্রিকেটারের ব্যাপারে ইনফরমেশন দিত। ১৯৯১ সালের দিকে, ইমরানের স্কাউটরা উনাকে একজন মোটা ব্যাটসম্যানের ব্যাপারে খোঁজ দেন। ইমরান ঐ মোটা, বোকাসোকা চেহারার ছেলেটিকে নেটে ডাকেন এবং ওয়াসিম ও ওয়াকারকে বললেন ঐ ব্যাটসম্যানকে আতঙ্কিত করার মতো বোলিং করতে। ঐ মোটা ব্যাটসম্যান হুক এবং পুল খেলল ফ্রন্টফুটে এবং দুই-ডাবলু কোন ভাবেই ওকে আউট করতে পারেনি।

নন-স্ত্রাইকিং এন্ডে দাড়িয়ে ইমরান ঐ ব্যাটসম্যানের খেলা দেখলেন এবং মনে, মনে বললেন, “এই ব্যাটসম্যান গড গিফটেড”। ইমরান সবার ‘না’ কে উপেক্ষা করে ঐ মোটা-বোকাসোকা-চেহারার-আনকোরা ব্যাটসম্যানকে বিশ্বকাপ দলে নেন এবং ইনজামাম-উল-হক ১৯৯২ সালে কি করেছিলেন সেটা সবাই জানেন।

ঘটনা ৩ঃ

বাংলাদেশ বনাম দক্ষিন আফ্রিকার দ্বিতীয় একদিনের ম্যাচ। দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলটি রাবাডা শর্ট-অফ-লেন্থ থেকে খুব জোরে ডিলেভার করেন। ব্যাটসম্যান লিটন দাস, ব্যাকফুটে যেয়ে হুক শট খেলেন এবং বলটি নিমিষের মধ্যে লংলেগে চলে যায়। ছক্কা!

চতুর্থ ওভারের তৃতীয় বল। রাবাডা মিডেল-এবং-অফে গুড-লেন্থ থেকে একটি বল ফেলেন জেতাকে খেলার নিয়ম হলো, একটু ব্যাকফুটে যেয়ে বোলারস ব্যাকড্রাইভ খেলা। কিন্তু লিটন ইম্প্রেসিভ ভাবে খুব আর্লি লেন্থ পিক করে ফেলে এবং ব্যাক ওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ফ্লিক করে চার মারেন। ওটাকে গ্লান্স-ফ্লিক বললে আরও ভালো শুনাবে। এবং সর্বোপরি, পেস বোলিং-এর বিরুদ্ধে লিটনের  ফুটওয়ার্ক খুবই ভালো।

এখন আসল কথাতে আসি।
        
কেন লিটন দাসকে দলে নেওয়া হয়েছে এটা নিয়ে অনেকেরই বেশ মাথা ব্যথা। বেশীরভাগ বাংলাদেশী ক্রিকেট ভক্তদের মতে লিটন দাস হিন্দু বলে দলে চান্স পেয়েছে। আচ্ছা এরা কি মানুষ না অমানুষ? কারো ভেতরে প্রতিভা না থাকলে শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে দলে চান্স পাওয়া যায় নাকি?

বাংলাদেশ দলে কতজন ব্যাটসম্যানকে আপনি এভাবে হুক শট খেলতে দেখেছেন? বাংলাদেশ দলে কত ব্যাটসম্যানকে পেস বোলিং-এর বিরুদ্ধে এত আর্লি লেন্থ পিক করে দেখেছেন?  যে দুটো শটের কথা আমি উল্লেখ করেছি সেই শট দুটো আবার দেখেন। 

লেন কিংবা ইমরান বড়, বড় সেঞ্চুরি কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটের ওপর নির্ভর করে ভিভ কিংবা ইনজামামকে দলে নেননি। লেন এবং ইমরান দুজনেই, ভিভ এবং ইনজির temperament, confidence, courage এবং stroke making abilities  জাজ করেই তাদেরকে দলে নিয়েছিলেন।

একজন তরুন এবং সম্ভবনাময় ক্রিকেটারকে শুধু ঘরোয়া ক্রিকেটের রান কিংবা বড়বড় সেঞ্চুরি দিয়ে বিচার করা ঠিক না। তাহলে বিশ্ব ক্রিকেট ভিভ, ইনজামাম কিংবা দুই ডাবলুকে পেত না। এই ধরনের ট্যালেন্টদের কিছু খোদা প্রদত্ত গিফট থাকে যেগুলো একজন জহুরীর চোখেই ধরা দেয়। আমদের কোচ চান্ডিকা হাথুরসিংহে হচ্ছেন সেই জহুরী যিনি লিটনের প্রতিভাকে বুঝতে পেরেছেন এবং তাই তো তিনি লিটনকে উপরের দিকে ব্যাট করান। এরকম প্রতিভাকে কেন নিচের দিকে খেলিয়ে অপচয় করবেন? এবং, ভুলে যাবেন না, গত মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে লিটনের পারফর্মেন্স ও খুব ভালো।

লিটন কেন দলে এই অহেতুক তর্কে না যেয়ে, এটা ভাবুন, বাংলাদেশ কতটা ভাগ্যবান এরকম একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে পেয়ে। নিজের মনটাকে বড় করুন। আপনি ওপরে, ওপরে বিশাল বড় চেতনাধারী হবেন কিন্তু মনে, মনে সাম্প্রদায়িক মোনভাব পোষণ করবেন সেটা কি ঠিক? আর ক্রিকেট খেলা নিয়ে আজাইরা চিল্লানোর পূর্বে এই খেলাটাকে বুঝুন এবং এর ইতিহাসের ব্যাপারে জানুন। চোখ বন্ধ করে কোন জাজমেন্টে আসলে আপনি নিজেই মূর্খ বলে বিবেচিত হবেন এবং সেটা হচ্ছেন ও!


ধন্যবাদ
ফয়সাল সিজার

No comments:

Post a Comment