Friday, August 25, 2017

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কের ভিত্তিটা অনেক মজবুত


এগারো বছরেরও বেশী সময় পর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল বাংলাদেশের মাটিতে টেস্ট খলেতে এসেছে। ভারত, দক্ষিন আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডের ন্যায় বড় দল গুলো নিয়মিত বাংলাদেশের সাথে বাইল্যাটেরাল সিরিজ খেললেও অস্ট্রেলিয়ার বাইল্যাটেরাল সিরিজ,২০০৬-এর পর, শুধুমাত্র তিনটি একদিনের সিরিজেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এক কথায়, সেই সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের মেরুদণ্ডবিহীন পারফর্মেন্স অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট খেলতে উতসাহিত করত না। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, বড় দল গুলো যদি সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দেয় তাহলে ছোট দল গুলো কিভাবে উন্নতি করবে? ভারত, দক্ষিন আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ড সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও অস্ট্রেলিয়ার আচরণ উৎসাহ ব্যঞ্জক ছিলো না।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলাদেশের সাথে তাদের সুসম্পর্কের ভিত্তিটা অনেক আগে থেকেই গড়ে উঠেছে।

                                      ***

৩১শে জানুয়ারি ১৯৭২ সালে, পশ্চিমা দেশ গুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম এবং চতুর্থ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার পূর্বে, স্বাধীনতা ঘোষনার প্রাক্কালে, ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় এবিসির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস রেডিও অস্ট্রেলিয়াছিল প্রথম বিদেশী মিডিয়া যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচারিত হয় এবং তার ফলে সমগ্র বিশ্ব সেটা জানতে পারে।

এক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির নেতা এডওয়ার্ড গোঘ উইথলামের অবদান ভোলার মতো নয়। ১৯৭১ সালে অস্ত্রেলিয়ান পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা হিসবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের হিউম্যানিটরিয়ান ক্রাইসিসের ব্যাপারটি হাইলাইট করেন। উনার বক্তব্যের একটি ইমপ্যাক্ট অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া এবং রাজনৈতিক মহলে পড়েছিলো  এবং সেজন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্ট্রেলিয়া গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর তিনি উৎফুল্ল চিত্তে ১৯৭১ সালে উল্লেখিত ব্যাপার গুলোর অবতারনা করেন।

শুধু তাই নয়, কমনয়েলথ দেশ গুলো যেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সেজন্য তিনি জোর প্রচারনা চালিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২০শে জানুয়ারি সিডনী মর্নিং হেরাল্ডারের একটি নিউজ রিপোর্ট থেকে উইথলামের ইতিবাচক পদক্ষেপ সম্পর্কে জানা যায়। ১৯৭৩ সালের আগস্টের দিকে, কানাডায় কমনওয়েলথ দেশ সমূহের হেড অফ স্টেটের একটি মিটিং-এ উইথলামের প্রচারনা কাজে দেয়। বাংলাদেশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই মিটিং-এ উইথলামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহামানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং দু বছর পর আবারও তদাএর সাক্ষাৎ হয়েছিলো।

উইথলামের উদারতা শুধু ইতিবাচক প্রচারনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর তিনি যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে অনেক অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ বিমানের উন্নয়নে তার অবদান ভোলার মতো নয়। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে ২০০ আসন বিশিষ্ট দুটো ফকার এফ-২৭ দেয় এবং বিমানের উন্নয়নের জন্য ৯৫০,০০০ ডলার আর্থিক সাহায্য দেন। দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ, বাংলাদেশ একটি বিমানের নাম “সিটি অফ ক্যানবেরা” রেখেছিলো।

১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অস্ট্রেলিয়ান এইড প্রোগরামের অংশ হিসেবে  অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে ৭৫০,০০০ ডলার মূল্যের ১৯০ টি ল্যান্ড রোভার জীপ দেয় এবং সেই সাথে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী সাহায্য স্বরূপ দেয়।

উইথলামের এই লেগেসি এখনও চলম্যান। বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান এইড প্রোগরামের আওতায়, ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্টের পরিমান ৫৭.৯ মিলিয়ন ডলার।        

                                    ***

এদিকে, ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমরে বীরোচিত অংশগ্রহণের জন্য বীরপ্রতীক সম্মান লাভ করেন। তিনি খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানীদের গণহত্যার অভিযান শুরু করে। অবিলম্বে বাঙ্গালীরাও প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙ্গালীদের এই প্রতিরোধ সংগ্রামে "ওডারল্যান্ড" সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং এমনকি পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধেও অংশ নেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি বাটা শু কোম্পানীর সিইও হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ২৫শে মার্চের অপারেশান সার্চলাইট এর পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পাকিস্তানীদের বর্বরতার বেশ কিছু ছবি তুলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পাঠান এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করেন। এর পরে মুক্তিবাহিনী গঠিত হলে তারা প্রাথমিকভাবে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল বেছে নেয়, এবং তখন আউডারল্যান্ড, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন যোদ্ধা ছিলেন, তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশান পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখেন।

টঙ্গীস্থ বাটা কোম্পানীর ফ্যাক্টরী এবং অফিসে তিনি গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেন, এবং ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশান পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি খাবার, পানীয়, ঔষধ ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন।
আউডারল্যান্ড সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন আমাদের দেশের জন্য, তা হল গুপ্তচর বা গোয়েন্দা হিশেবে কাজ করে পাকিস্তানি বাহিনীর নানান তথ্য মুক্তিবাহিনীকে জোগাড় করে দেওয়া। এই কাজে তার দক্ষতা, চাতুর্য ও সাহসিকতা সত্যিই প্রশংসনীয়। 

পাকিস্তান বাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে তিনি কৌশলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং এভাবে ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশাধিকার লাভ করেন। পরে তিনি গভর্ণর জেনারেল টিক্কা খান এবং মেজর রাও ফরমান আলীর সঙ্গেও যোগাযোগ গরে তোলেন। তিনি বিদেশী হওয়াতে তার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছিল। তিনি জেনারেল নিয়াজীর বিশেষ বন্ধুহিশেবে পাক-বাহিনীর সদর দফতরে অবাধ যাতায়াতের অনুমতি পান। সেক্টর দুই এর মেজর এটিএম হায়দারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হত এবং তিনি পাকিস্তান বাহিনীর নানা গোপন তথ্য মেজর হায়দারকে সরবরাহ করতে থাকেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালীজাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। ২০০১ সালের মে মাসে তিনি মৃত্যুবরন করেন।    

                                      ***

এখন আসি হার্ব ফিথের কথায়। ২০১৩ সালের ২৪শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশ সরকার ৪৪ জন ভারতীয় সহ মোট ৬৮ জন বিদেশী নাগরিককে ফ্রেন্ডস অফ লিবারেশান ওয়ারসন্মাননা প্রদান করে। সেই তালিকায় একজন অস্ট্রেলিয়ানও ছিলেন, যার নাম হার্ব ফিথ। হার্ব ফিথ মোনাশ ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন এবং বর্তমানে মোনাশে তার নামে একটি ফাউন্ডেশন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে হার্ব ফিথের এই মরনোত্তর সন্মাননা গ্রহন করেন তার ছেলে ডেভিড ফিথ, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য এই জাতির তরফ থেকে সন্মান ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনরূপে প্রদান করা হয়।

ডেভিড ফিথ তার এই ঢাকা সফরকে নিয়ে একটি দীর্ঘ রিপোর্ট লিখেছেন  যা মোনাশ ইউনিভার্সিটির হার্ব ফিথ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। এই রিপোর্টে ডেভিড মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে তার বাবার যাবতীয় কর্মকান্ড তুলে ধরেছেন

ডেভিড ফিথ লিখছেন, পঁচিশে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) মানবিক বিপর্যয়ের খবর যখন মিডিয়া-মারফত মেলবোর্নে পৌঁছায়  তখন তার বাবা হার্ব ফিথ সহ বেশ কিছু মানুষ তা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েনপাকিস্তান বাহিনীর ভয়ানক নৃশংশতা তাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। পুরো ১৯৭১ সাল জুড়েই ফিথ ও তার বন্ধুরা বাংলাদেশে চলা রাষ্ট্র বনাম জনগণ অসম যুদ্ধ এবং উদ্বাস্তু সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তারা ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলা দেশ গঠন করেন, যার আহবায়ক ছিলেন হার্ব ফিথ, সঙ্গে ছিলেন মার্ক র্যানপার, চার্লস চোপেল, জন ডানহাম, ডেভিড স্কট এবং আরো অনেকে। 

এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল এরকমঃ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, অথবা বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের আকাঙ্খার ভিত্তিতে এমন একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা যেখানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরেই এই জনগোষ্ঠীর নিজেদের যথেষ্ঠ স্বায়ত্বশাসন থাকবে, যাতে বাংলাদেশের মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে এবং যে উদ্বাস্তুরা পার্শ্ববর্তী দেশে আছে, তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে পারে।

এই কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশের চলমান সংকট সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য লিফলেট ও পোষ্টারের মাধ্যমে প্রচার করেন, এই বিষয়ে সেমিনার আয়োজন করেন, ত্রাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন, এমনকি অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যদেরকে বাংলাদেশে জরুরীভিত্তিতে ত্রানসামগ্রী পাঠাতে এবং সেদেশের সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করতে চাপ প্রদান করেন।
                                    ***

সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটিতে বার্ষিক এশিয়ান লেকচার সিরিজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বক্তব্য দেন হার্ব ফিথ। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল Asia’s Flashpoint, 1971: Bangladeshসেখানে তিনি এই সমস্যার যে সুত্রপাত, অর্থাৎ ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের যে বঞ্চনা ও শোষন, সেগুলোর উল্লেখ করে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, এবং সেসময় ভারতে অবস্থানকারী কয়েক মিলিয়ন বাংলাদেশি উদ্বাস্তুর আশু-পূনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তার উপরে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেন।

হার্ব, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও আলোচনা করেন, এবং কেন এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায়-যুদ্ধ আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অন্যায়-যুদ্ধ, তা ব্যাখ্যা করেন।

 এই লেকচারটি পরে লিখিত আকারে সবার মাঝে বিতরণ করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তান কেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়, সেই দাবীর যৌক্তিকতা ইতিহাসের আলোকে প্রমাণ করে দেওয়া হয়। কেন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় জরুরী, তা তিনি খুব স্পষ্ট করেই যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন তার পাঠকদের সামনে।  

হার্ব ফিথ ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে স্বাধীন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। পরে আরেকবার তার যাওয়া হয়েছিল রিসার্চের কাজে, যেখানে তিনি উদ্বাস্তুদেরকে নিয়ে কাজ করছে এমন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদের ব্যাপারেও তার সহানুভুতি ছিল তিনি তাদের ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, তাদের বসবাসের অস্বাস্থ্যকর ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ ও অপর্যাপ্ত খাবার পানি, স্যানিটেশান ও পয়োনিষ্কাশন নিয়ে নানাজনের সাথে কথা বলেছেন, এবং ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউতে বিহারো সরো নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৩ই মে ১৯৭২ সালে।

                                     ***

ভারতীয় শিবিরে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষদের সাহায্যের জন্য অনেকেই বিভিন্ন ভাবে অব্দান রেখেছেন। ভূরাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক কারনে মুক্তিযুদ্ধের সব খবর প্রচারিত হতো না। শুধুমাত্র যারা দক্ষিন এশিয়ার ব্যাপারে জানতেন তারাই তাদের সমবেদনা এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।

মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরাস্থ অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট এই সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন একদল একটিভিস্ট, অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশী শরনার্থীদের জন্য বেশি বেশি সাহায্য প্রদানে চাপ সৃষ্টি করার জন্য। বাইশ বছর বয়সী ডেভিড এলিস, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন টিউটর, এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন, এবং তার সঙ্গে আরো যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র মাইক ক্রেমার এবং ফার্স্ট এইড অফিসার ডক্টর এলেক্স রস ছাড়া আর কারো নাম জানা যায় না। শুরু করেছিলেন যারা, সবাই শেষ করতে পারেননি অসুস্থতা, দূর্বলতা, সানস্ট্রোক ও পানিশুন্যতার কারণে। শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন সাতজন।

১৯৭১ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখে যাত্রা শুরু করে তারা ডিসেম্বরের সাত তারিখে ক্যানবেরায় পৌঁছান এবং সেখানে ফেডারেল পার্লামেন্টের সামনে এক প্রতিবাদসভার আয়োজন করেন। ডেভিড বলেন, অস্ট্রেলিয়ান সরকার বাংলাদেশের শরনার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে। সরকারের উদ্দেশ্য শুধু এশিয়াতে সামরিকভাবে জড়িত থাকা, কিন্তু মানবিক বিপর্যয়ের মুখে তাদের যে কর্তব্য, তা তারা ভুলে গেছে। সেখানে দুজন মেম্বার অফ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভও বক্তব্য দেন।

                                      ***

মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, অভুক্ত, দুর্বল ও অসুস্থ শরনার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার Knoll Laboratories পাঠিয়েছিল পাঁচ মিলিয়ন মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট। সিডনী মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ১৬ই জুন, ১৯৭১ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তারা ভারতীয় রেড ক্রসের মাধ্যমে এই ট্যাবলেট বিতরণের জন্য বিমানযোগে কলকাতায় পাঠায়। কোম্পানীর কর্মচারীরা এক ছুটির দিনে আর্নক্লিফে তাদের কোম্পানীর ওয়্যারহাউজে উতসবমুখর পরিবেশে তাদের বাংলাদেশী বন্ধুদের জন্য এই শিপমেন্ট প্রস্তুত করে। ক্যানবেরার Pettit & Sevitt নামক একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি উদ্বাস্তুদের জন্য অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে আবেদন করেছিল তাঁবু, ট্রাপলিন, স্লিপিং ব্যাগ, কম্বল, গরম কাপড় ও খাবার-দাবারের। এংলিক্যান চার্চের সহযোগীতায় তারা বেশ কিছু নগদ অর্থ এবং অন্যান্য সাহায্য পায়, এবং সেগুলি AustCare এর মাধ্যমে ভারতে পাঠায়। Gollin & Company পাঠায় প্রায় ছয়হাজার ডলার মুল্যমানের তিন মাইল লম্বা পলিফেব্রিক, যা শরনার্থীদের জন্য অস্থায়ী আবাস বানাতে কাজে লেগেছিল। AustCare প্রায় দুই লাখ ডলার নগদ অর্থসাহায্য পেয়েছিল তাদের ফান্ড-রেইজিং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

                                    ***

২৬শে জুন ১৯৭১ তারিখে সিডনীর তরুন সঙ্গীতশিল্পী জেনি হ্যারিস AustCare এর আবেদনে সাড়া দিয়ে হার্স্টভিলে আয়োজন করেন একটি চ্যারিটি কনসার্ট। সেই অনুষ্ঠানে আরো গান করেন সিলভিয়া রে, দি পিটার লেইন অর্কেস্ট্রা, ইয়ং ওয়ার্ল্ড সিঙ্গারস নামে একটি গ্রুপ, ডায়ান হিটন ব্যালে, এবং কিথ হ্যারিস। যুদ্ধের শেষের দিকে, নভেম্বরের মাঝামাঝিতে, জনপ্রিয় পপ গায়ক বিলি থর্প পরিকল্পনা করেছিলেন এক টেলিথনের, যা কিনা প্রচারিত হবে ১৯৭১ সালের ক্রিসমাসের দিনে। এখানে একটু ব্যাখ্যা করি, টেলিথন হল টেলিভিশন ও ম্যারাথন শব্দদুটির সহযোগে বানানো একটি শব্দ, যার অর্থ হল এমন কোন চ্যারিটি বা তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠান, যা টেলিভিশনে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচারিত হয় কয়েক ঘন্টা, দিন বা সপ্তাহ ধরেও হতে পারে।

বিলির পরিকল্পনা প্রশংসা কুড়িয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সব মহলের, এবং বিশটিরও বেশি মিউজিক গ্রুপ তাদের অংশগ্রহনের ইচ্ছা জানিয়েছিল এই আয়োজনে। বিলি থর্পের আরো ইচ্ছা ছিল অংশগ্রহণকারী সব শিল্পীকে নিয়ে একটা সিঙ্গেল ট্র্যাক করার, যেটির রয়ালটি থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্য দান করা হবে। দুঃখের বিষয়, এই টেলিথনটি আদৌ আয়োজিত হয়েছিল কি-না সে ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় কিছু জানা যায় নি।  

                                     ***

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনজন অস্ট্রেলীয় নাগরিক দিল্লীতে গিয়েছিলেন একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য। জন ডানহাম, স্যালি রে ও জনসন। হঠাত করেই তারা পরিকল্পনা করলেন, ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত তারা পার হবেন হাতে উই রিকগনাইজ বাংলাদেশ লেখা ব্যানার নিয়ে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা জানানো এবং মানুষ ও মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষন।

তাদের এই উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলেছিলো  এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিলো পাকিস্তান বর্ডার চ্যালেঞ্জকুটনৈতিক কারণে ভারত সরকার অবশ্য তাদেরকে নিরস্ত করেন এবং সেকারণে তাদের এই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। তবে তারা থেমে থাকেননি
         
নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছেন বাংলাদেশের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষন করতে। জন ডানহাম তার লেখায় ও বক্তব্যে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে তার জোরালো মত তুলে ধরেন এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করেন। দি এজ পত্রিকার ২২ ও ২৩শে সেপ্টেম্বরের দুটো রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই তিনজন সবমিলিয়ে সাত দেশের বারোজনকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপত্র হাতে নিয়েতারা এই প্রতিকী সীমান্ত-অতিক্রমকে গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা বলে বলে জানান। এর আগে লন্ডনভিত্তিক ওমেগা রিলিফ টিম পাকিস্তান সরকারের অনুমতি ছাড়াই বাংলাদেশে ঢোকায় পাকিস্তান সরকার তাদেরকে বহিষ্কার করেন। তাদের আরো একটি দলকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার এই চেষ্টা শুধু প্রতিকী অর্থেই নয়, ব্যবহারিক অর্থেও বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে এক বড় ধাপ।

                                      ***

অতঃপর, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তি অনেক মজবুত। এটা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকেও বুঝতে হবে। ঐতিহ্যগত ভাবে যেখানে সম্পর্কের ভিত্তিটা এত মজবুত সেখানে বাংলাদেশের সাথে অস্ট্রেলিয়ার নিয়মিত বাইল্যাটেরাল সিরিজ খেলায় কেন উদাসীন সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আশা করি এই মানসিকতার পরিবর্তন আসবে।


তথ্য সংগ্রহঃ উইকিপিডিয়া, মিজান মান্নান নামক একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর পোস্ট, ক্রিকেটসকারে আমার নিজের ইংরেজি আর্টিকেল, মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ব ফিথ ফাউন্ডেশানের ওয়েবসাইট, হার্ব ফিথের জীবনী ফ্রম ভিয়েনা টু জাকার্তা, ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ পেপারস, ১৯৭১ এবং ১৯৭১ সালের বেশ কিছু অস্ট্রেলিয়ান নিউজপেপারের রিপোর্ট এবং  তাহমিনা আনামের এ গোল্ডেন এইজ।    

ধন্যবাদ 
ফয়সাল সিজার 

No comments:

Post a Comment