Saturday, May 27, 2017

সেন্ট্রাল হাসপাতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নৃশংসতা এবং নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা


সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসকের উপর বর্বরোচিত হামলার ভিডিও দেখে হয়ত অনেকেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন চিকিৎসকদের সাথে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে আমি নিজেই এরকম পরিস্থিতির মোকাবেলা কয়েকবার করেছি উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার অবতারনা করছিঃ

২০০৭ সালের এপ্রিল মাসের দিকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চকারিরত অবস্থায় লাজফার্মার মালিকের লোকজন এসে কিছু অন্যায় আবদার করতে আসলে আমি মানতে রাজি হইনি এবং উনারা আমাকে কটাক্ষ করে কথা বললে আমি মুখের উপর রুক্ষ ভাবে পাল্টা জবাব দেই

এটা শুনে তারা পশ্চিম রাজাবাজার থেকে একদল গুন্ডা ভাড়া করে এনেছিলো সেই হাসপাতলের পঞ্চম তলায় ভাংচুর করতে হাসপাতালের ড্রাইভার ভাই, যিনি আমার খুব ভক্ত ছিলেন, পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমাকে টি রুমে যেতে বলেন এবং মেইন গেট বন্ধ করে দেন

গুন্ডারা এসে ঢুকতে না পেরে আম্মাকে গালি দিতে থাকে এবং বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে থাকে পরে হাসপাতাল পরিচালক এসে পুরো ঘটনা শুনে লাজ ফার্মার মালিককে ফোন দেন এবং আমার ভাষ্য নেন যেখানে দেখা যায় তাদের কথা মেনে না নেয়াটাই ঠিক ছিলো লাজ ফার্মার মালিক তার লোকদের ভাড়া করা গুণ্ডাদের চলে যেতে বলেন

একজন বাচ্চা রোগীর রুমে, যে কিনা গুইলিয়ান বেরি রিগে আক্রান্ত, আমি যদি রোগীর লোকদের ভিড় জমাতে নিষেধ করি এবং শুধু মা ছাড়া আর সবাইকে ঢুকতে নিষেধ করি তাহলে আমি কি খুব অন্যায় করেছিলাম? কিন্তু তারা জোর করে থাকবে কারন তারা নিজদেরকে ভিআইপি বলে দাবী করছেলিনে আজিব টাইপের ভিআইপি!

  একই বছর, বর্ষার মৌসুমে, একজন রোগী আসেন যিনি নিজেকে বাংলাদেশের স্বনামধন্য নাট্য অভিনেতার খুবই ক্লোজ আত্মীয় বলে পরিচয় দেন ভালো কথা আমি পুরি হিস্ট্রি নিয়ে এবং এক্সামিনেসন করে চেয়ারে বসে রোগীর ফাইনডিংস অর্ডার লিখছিলাম রোগীর হাপানি সহ আরও কিছু বয়স্কজনিত সমস্যা ছিলো এম এন আলম স্যারের কাছে চেকাপ করাতে ভর্তি হয়েছিলেন হঠাৎ করে উনি বিকট চিৎকার করে অসভ্য ভাসায় গালিগালাজ করে আমাদের একজন সিস্টারের চুল ধরেন এবং আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হারামির বাচ্চা! তোরা রুমে খাবারের পানির গ্লাস দ্যাশ না কেন”?

আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো আমি বললাম ভদ্র হয়ে কথা বলতে এবং একজন মেয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না! বলে দিলাম আমি চিকিৎসক রুমে জগ, বালতি, মগ ইত্যাদি দেবার দায়িত্ব কি আমার নাকি? আমি নিজেও গালি দিয়ে বললাম এখানে না থেকে জংগলে যেতে

 ঐদিকে হাসপাতালের সিকিউরিটি টিম এসে লোকটিকে রুমে যেতে বললে লোকটি গজ, গজ করতে রুমে চলে যায় একটু পরেই আমার টেবিলের ওপর পাশে একজন টিভি অভিনেত্রী, যিনি ত্রপা মজুমদার নামে পরিচিত, এসে বসেন এবং আমার কাছে রোগীর লোকদের পক্ষ থেকে সরি বলেন এবং সিস্টারদের কাছেও পুরো ঘটনার জন্য ক্ষমা চান আমি উনাকে শুধু বলেছিলাম দিদি, আমরা চেষ্টার ত্রুটি করি না আমাদেরকে শুধু প্রাপ্য সম্মানটা দিন

২০০৯ মহাখালির বক্ষব্যধি হাসপাতালে নাইট শিফট করছিলাম যক্ষ্মা কেন্দ্রে আমার ডিউটি এবং ওপর প্রান্তে অ্যাজমা সেন্টারে আমার এক কলিগের ডিউটি এমন সময় তিতুমির কলেজের প্রায় একশোর উপর ছাত্রদের একটি জটলা দেখলাম যারা তদের এক ছুরিকাহত সহপাঠীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে এসেছে কর্তব্যরত চিকিৎসক আহত ছাত্রকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফারড করেন ঢামেকে কেন রেফারড কড়া হলো সেটা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে তারা ভাংচুর শুরু করল পরিস্থিতি খারাপ দেখে ইমারজেন্সি চিকিৎসক কোনমতে পিঠ বাচিয়ে কক্ষ ত্যাগ করেন এবং উত্তেজিত ছাত্ররা অন্যান্য চিকিৎসকদের খুজতে থাকে আমি গলার স্টেথো নামিয়ে যক্ষ্মা কেন্দ্রের চিকিৎসক রুমের দিকে দৌড় দেই পেছনে ফিরে দেখি আমার কলিগ আমার পেছন, পেছন আসছে

দুজন মিলে ডক্টরস রুমে ঢুঁকে বাতি নিভিয়ে দেই কারন যক্ষ্মা কেন্দ্রের দিকটা এতটা অন্ধকার যে বাতি নিজিয়ে দিলে কিছুই তেমন বুঝা যায় না বাতি নেভানোর পর জানালা দিকে লুকিয়ে দেখি প্রায় বিশ জনের একটি দল হুংকার দতে, দিতে যক্ষ্মা কেন্দ্র ক্রস করে এবং তদাএর মধ্যে একজন বলতে লাগলো, “মাদারচোদ গুলান কই? একটাও নাই এখানে! সব গুলার পিছে আজকে চাপাতি ঢুকাবো”!

প্রায় তিন ঘণ্টা বাতি নিভিয়ে থাকার পর হট্টগোল থেমে যায় এবং যাত্রায় দুজন মিলে বেচে যাই

২০১০ সালে শ্যামলীতে একটি ক্লিনিকে ২৪ ঘণ্টার কামলা ছিলাম এলাকার এক হোমরা-চোমরা এসে কোন পারমিশন না নিয়েই চিকিৎসকদের রুমে ঢুঁকে যায় আমি জিজ্ঞেস করলাম কাকে চান উনি বলে উঠলেন আমি এলাকার অমুক আপনার স্যারকে বলুন আমাকে দেখে দিতে আমি বললাম আপনার সিরিয়াল থাকলে উনি এমনিতেই দেখে দিবেন উনি আমাকে বললেন উনার সিরিয়াল লাগবে না আপনার স্যারকে বলেন আসতে আমি আবারো বললাম উনি সিরিয়াল ছাড়া দেখবেন না এরপর আমাকে রুক্ষ সুরে বললেন, “তুই আমারে চিনিস? আমি এক ফু দিলে তুই শেষ”! আমি হেসে, হেসে বললামআমি তখন তর লুঙ্গি ধরে তান দেবো তাহলে তুইও শেষ হয়ে যাবি

উনার সাথে তিনজন লোক আমাকে ঘিরে ধরল ওদিক থেকে আমার সিনিয়রেরা আসলেন এবং উনি তাদের সাথেও কুতর্ক করলেন এবং আমাদের এক ওয়ারড বয়কে থাপ্পর মারে আমি আমার কাজিনকে ফোন দিয়ে জানালাম আমার পুলিশ প্রটেকশন দরকার আমার কাজিন দুজন পুলিশ পাঠিয়ে দিলেন এবং আমার এই রূপ দেখে লুঙ্গিওয়ালা নিজেই অফ হয়ে যায়

নিজের জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু বিপদ-সংকুল ঘটনার অবতারনা করলাম এই পর্যন্ত অভিজ্ঞতা মন্দ না এবং শিক্ষাটা হলো নিজের প্রটেক্সন নিজেরই দেওয়া শিখতে হবে

ধন্যবাদ
ফয়সাল সিজার 


No comments:

Post a Comment